সিদ্ধেশ্বরী লেনে কোচিংয়ের হাট





নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে দৈনিক বা প্রতিদিন অন্য যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন।
সিদ্ধেশ্বরী লেনের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কত কোচিং সেন্টার আছে বা কত শিক্ষক সেখানে কোচিং করান বা প্রাইভেট পড়ান, তার সঠিক হিসাব পাওয়া দুরূহ। কেবল দুটি পাশাপাশি ভবনেই ৩০টির মতো কোচিং বা শিক্ষকের নামে এমনকি বিভিন্ন বিষয়ের নাম উল্লেখ করে সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে।     
ভবনের দেয়ালগুলো বলছে, মানিক স্যার, জিকু স্যার, আর কে স্যার, সূত্রধর স্যার, ফরিদ স্যাররা সিদ্ধেশ্বরী লেনের একই বাসায় বিভিন্ন বিষয়ে পড়াচ্ছেন। তালিকায় বাংলা, ধর্মসহ সবই আছে।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দাবি, নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরা ঠিকমতো পড়ান না। ক্লাসের পাঠদানের পদ্ধতিতেও দুর্বলতা আছে। কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০ জনের বেশি। এত বেশি শিক্ষার্থীকে পড়ানো, বোঝানো শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে কোচিংয়ে আসেন।
সরকার বাণিজ্যিক কোচিং বন্ধ করার চেষ্টা করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, কোচিং বন্ধের জন্য শিক্ষা আইন, ২০১৬-এর খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কমিটি তা যাচাই-বাছাই করছে। যাচাই-বাছাই শেষে খসড়াটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।
গত বৃহস্পতি ও সোমবার বেইলি রোড–সংলগ্ন সিদ্ধেশ্বরীর কয়েকটি গলিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক শিক্ষকের নামে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের কথা উল্লেখ করে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, লিফলেট সাঁটানো আছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষকের নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম তাতে উল্লেখ নেই।
অধিকাংশ সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, একেকটি কক্ষে এক ব্যাচে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী পড়ছে। উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ের জন্য ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা করে দিতে হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা, ২০১২’তে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষকের নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে বা এর পূর্বে অথবা পরে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে বা বাইরে কোনো স্থানে পাঠদানের লক্ষ্যে কোনো দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি, পোস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন, ব্যানার বা দেয়াললিখনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কোচিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। তবে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধু অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। এর বাইরে কোনো শিক্ষক তাঁর 


এরপর জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন, ২০১৬-এর খসড়া প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে প্রাইভেট টিউশন, কোচিং এবং নোট বই, গাইড বই নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়। এই আইন না মানলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বাণিজ্যিকভাবে কোচিং ক্লাস করাচ্ছেন না। প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। এতে নীতিমালা ভঙ্গ হচ্ছে না। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও পড়ান।
তবে অন্য দুজন শিক্ষক দাবি করেছেন, তাঁরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ান না। অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে পড়তে আসে। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে তারা পড়তে আসে। তবে এর জন্য নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তাঁরা কিছু বলেননি। 
সুলতানা সামিহা একটি নামকরা কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ছেন। দুপুরে ক্লাস শেষ হওয়ার পর দুই থেকে তিনজন শিক্ষকের কাছে পড়তে যান। সব কোচিং ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়।
অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, শিক্ষকদের নিজের প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের জন্য বরাদ্দ সময় যথেষ্ট নয়। এ সময়ের মধ্যে তারা নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়া শেষ করতে পারেন না। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ১৫০ থেকে ২০০–এর মধ্যে। এত বেশি শিক্ষার্থীর কারণে তাঁরা মনোযোগ দিতে পারেন না। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিটিও এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি আয়ত্তে আসেনি। এসব কারণে বাধ্য হয়ে কোচিংয়ে দৌড়াতে হয়।
এখানে কোচিং করতে আসা বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুজন শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাসে সব পড়া বোঝা যায় না। শিক্ষকেরা নিজেদের মতো করে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান।
সিদ্ধেশ্বরী লেনে অভিভাবক মাহমুদা পারভীন ও নারগিস আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো করে পড়ালে এত কষ্ট করে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হতো না। ক্লাসে পড়াটা ঠিকঠাকমতো বুঝিয়ে দিতে হবে। স্যার ও ম্যাডামরা নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নিচ্ছেন। তারপরও ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ক্লাসের পর বাচ্চাদের কোচিংয়ে দৌড়াতে তাঁদের ওপরই বেশি চাপ পড়ে। আর একজন সন্তানের পেছনে মাসে বাড়তি ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে একাদশ শ্রেণির কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন এক অভিভাবক। তিনি বললেন, আগে থেকে পড়লে পরে পাঠ্যসূচি ভালো বুঝতে পারবে। বাসায় শিক্ষক দিয়ে পড়ানোর ক্ষমতা নেই। তাই ব্যাচে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।
কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য বলেন, শিক্ষকদের কাছে না পড়লে পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার ভয় থেকেও অনেকে সন্তানদের কোচিংয়ে পড়াতে পাঠান।